মার্চ ২৩, ২০২৩ ১:৩২ বিকাল



মা

গল্পঃ- মা

______রিপন ইসলাম রবি_____

‘মা সময়মতো খাবার খেয়ে নিও’_ এই কথা শেষ হতে না হতেই ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
রবি আর কথা বলতে পারল না।
সে আবার কল করলো মায়ের ফোনে, কিন্তু ফোন বন্ধ।
রবি ভাবলো হয়তো ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে, তাই এত রাতে মাকে না জাগিয়ে কাল কল করবে।
পরের দিন অফিসে যাওয়ার সময় সে আবার কল করলো মায়ের ফোনে, কিন্তু ফোনটা তখনও বন্ধ-ই রয়ে গেছে।
মায়ের আবার কিছু হলোনা তো! ভাবতেই রবির বুকটা কেঁপে উঠলো।
দুশ্চিন্তা করতে করতে রবি অফিসে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর রবির ফোনে একটা কল আসলো।
। রবির বন্ধু রাসেল কল করেছে।
‘রবি, কেমন আছিস তুই?’
‘হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, তোর কী খবর?’ রবি উত্তর দিল।
‘হ্যাঁ আমিও ভালো আছি রে’।

রাসেল কেমন জানি একটু সঙ্কোচ ভাব নিয়ে কথাটা বললো। রবি ঠিক বুঝতে পারলো রাসেল কোনো কারণে মন খারাপ।
তাই সে রাসেলকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা রাসেল তোর কি কিছু হয়েছে?’
‘না দোস্ত, আমার কিছুই হয়নি, কিন্তু…।’
‘কিন্তু কী? বল।’
‘তোর মা একটু অসুস্থ’
রবির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, সাথে বুকে চিনচিন ব্যাথা।
রবির কান্নার স্বরে রাসেলকে জিজ্ঞেস করলো, ‘মায়ের কী হয়েছে রাসেল? বল না।’
‘তেমন কিছু না, তুই চিন্তা করিস না, ছুটি নিয়ে কালকেই চলে আয়।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুই মায়ের খেয়াল রাখিস।’

ফোনের লাইন কেটে দিয়ে নিজের ডেস্কে বসে কাঁদতে লাগলো রাসেল। অঝোরে পানি পড়তে লাগলো দুটি চোখ হতে।
রবির দুশ্চিন্তা ক্রমশই বাড়তে লাগলো।
অফিসের বস্-কে বলে ছুটি নিয়ে পাড়ি জমালো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রবি বসে আছে বাসের ছিটে, চোখ দিয়ে বয়ে চলেছে অজশ্র কান্নার ঢল। বসে বসে ভাবতে লাগলো তাদের পুরনো দিনের কথা।
রবির বাবা ছিলেন একজন দিনমজুর।তবুও বাবা-মার আদরের ছেলে রবি।
হঠাৎ করেই হার্ট এ্যাটাক করে মারা যান রবির বাবা।সেই থেকে রবির আর তার মায়ের জীবনে শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
কত শত অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট যে ঘিরে ধরে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
গ্রামের মানুষ তাদের কষ্ট দেখে কিছু সাহায্য করেন।

অনেকে আবার বলেন, ‘ও রবির মাও, নিজে এত কাম না কইরা পোলাডারে কামে লাগাও।’
প্রতিবার-ই রবির মায়ের একই জবাব, ‘ক্যান, মোর পোলা কাম করবো ক্যান? মোর পোলায় চাকরি করবো, চাকরি কইরা মোরে ঢাকায় নিয়া যাইব তহন মুই আর কাম করমু না।’
সংসার চালাতে মানুষের বাসায় কাজ করতে হতো রবির মাকে।
মানুষের বাসায় কাজ করে যা পান তা মা-ছেলে ভাগ করে খান।
শত শত কষ্টের সাথে যুদ্ধ করে পড়ালেখা চলতে থাকে রবির। অসহায় মায়ের কষ্টগুলোকে স্বাক্ষী রেখে শপথ করে সে, যত দ্রুত সম্ভব পড়ালেখা শেষ করে চাকুরি নিয়ে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে।
সকল ধরনের কষ্টগুলোকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। একসময় পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় পাড়ি জমায় রবি।
ছোট্ট একটা চাকরি-ও পেয়ে যায়, কিন্তু বেতনটা খুবই কম।
এই ছোট চাকরির বেতন দিয়ে চলা সম্ভব নয়। তাই রবি অপেক্ষা করে যদি প্রমোশন হয়ে যায় তখন মাকে ঢাকায় নিয়ে আসবে, অনেক কষ্ট করেছে মা।
বাবা মারা যাওয়ার পর বিশটা বছর অনেক পরিশ্রম করেছে অসহায় মা।
এবার মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।

বাস তার আপন গতিতে ছুটে চলেছে গাইবান্ধার দিকে। কয়েক ঘন্টা পর গ্রামে পৌঁছে গেল রবি।
বাড়ির কাছে আসতেই বাড়ির উঠোনে অনেক মানুষের ভিড় দেখতে পেল সে।
অজানা এক ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো।
ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতেই কিছু একটা দেখে থমকে গেল সে।
ওর সামনে এখন খাটের ওপর শোয়ানো একটা লাশ, রবির মমতাময়ী মায়ের লাশ।
বুক ফেঁটে চাপা কান্না আর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ে রবির।
কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় সে।
রবি যখন ঢাকায় ছিলো তখন তার মা তাকে বলেন, ‘বাপজান আমার লাইগা একটা সুয়েটার নিয়া আসবি?, অনেক শীত পড়তাছে রে বাপ তাই আমার ভীষণ শীত করে।’
মায়ের সেই কথা মনে পড়তেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো রবি।
মায়ের জন্য চাঁদর আর একটা সুয়েটার এনেছে সে।
সুয়েটারটা বের করে মায়ের লাশের উপর রেখে সে বলতে লাগলো, ‘মা, ও মা তুমি কেন চলে গেলে আমাকে একা রেখে, দেখো মা তোমার ছেলে ফিরে এসেছে, তোমার আর ঠান্ডা লাগবেনা মা, আমি তোমার জন্য সুয়েটার আর চাঁদর এনেছি, এই যে দেখো, স্বপ্ন পূরণ হতে না হতেই তুমি চলে গেলে গো মা।’
রবির চিৎকারে যেন আকাশ-পাতাল কাপতে লাগলো।
রবির এরকম অবস্থা দেখে বাড়ির উঠোনের সব লোকজন বলতে লাগলো, ‘পোলাডা মনে হয় পাগল হইয়া গেছে মায়ের মরণের কারনে।’

মায়ের লাশের পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে কয়েকবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে।
গ্রামের মুরব্বী লোকেরা বুঝিয়ে শান্ত করলো ওকে।
কিছুক্ষণ পর শুরু হলো লাশ দাফনের প্রস্তুতি।
রবির মমতাময়ী মাকে কবরে রাখার জন্য কবর প্রস্তুত করা হচ্ছে।
মাকে সুন্দর করে গোসল করানো হলো, সাদা কাপড়ে মোরানো হলো লাশ।
বাঁশ কাঁটা হলো এবং কবরের সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো।
লাশ জানাযা করার জন্য রবির বাড়ির পাশের স্কুল মাঠে নেওয়া হলো।
জানাযা সম্পন্ন করে খাঁটিয়ায় করে লাশ কবরে নিয়ে যাওয়া হলো। রবি-সহ চারজন কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে লাশ।
মায়ের লাশ রবির কাঁধে, এটা যেন সে বিশ্বাসই করতে পারছে না।
তাই তো কষ্টে বার বার কেঁদে উঠছে সে।
লাশ যখন কবরে রাখা হলো তখন রবি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো।
সে আবার বলতে লাগলো, ‘মা, ও মা কেন একা রেখে গেলে। মা তোমার তো এই মাটির ঘরে একা একা ঠান্ডা লাগবে গো।’
রাসেল আবার বুঝিয়ে শান্ত করলো রবিকে। কিছুক্ষণের মধ্যে দাফন সম্পন্ন হলো। মাকে কবরে রেখে আসলো রবি।
শুধু মা না, সাথে রেখে আসলো এক মমতাময়ী মায়ের স্বপ্নকে।
কেটে গেল আরও বেশ কিছুদিন। মাকে হারিয়ে যেন পাগলের মতো হয়ে গেল সে। আস্তে আস্তে সহ্য করে বেশ কিছুদিন পর শহরে ফিরে আসলো রবি।

রবির মায়ের মতো হাজারো মমতাময়ী মায়ের স্বপ্ন এভাবেই বিলীন হয়ে যায়।
সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে শেষে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয় এইসব মমতাময়ী মহীয়সীদের।
সারাজীবনের কষ্টগুলো ঘোঁচানোর আগেই নিভে যায় জীবন প্রদীপ।
সারাজীবনের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যায় এইসব মমতাময়ী মায়েদের।
মমতাময়ী মায়ের ভালোবাসা আর উৎসাহের কারণেই একটা ছেলে তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষে ছুটতে থাকে।
স্বপ্ন একদিন ঠিকই পূরণ হয়ে যায়, কিন্তু ততদিনে স্বপ্ন দেখানো মানুষটা আর থাকে না।
চলে যায় না ফেরার দেশে।

এমন সব মমতাময়ী মায়েদের পায়ের জুতা আমরা যদি নিজের শরীরের চামড়া দিয়ে তৈরি করে দিই তবুও ঋণ শোধ হবে না।
আল্লাহ্ প্রত্যেকটা মহীয়সী মমতাময়ী মাকে বেহেশত নসীব করুন।
শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি মমতাময়ী মায়েদের।
মমতাময়ী মায়েরা সারাজীবন অমর হয়ে থাকবে তাদের ছেলেদের হৃদয়ে।

________®সমাপ্ত®________



Comments are closed.

      আরও নিউজ