মার্চ ২৪, ২০২৩ ১২:১১ সকাল



হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের “মুন্সিবাড়ী”

ডেস্ক রিপোর্ট: বর্তমানে কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরের একমাত্র কালের সাক্ষী ধরণীবাড়ী রাজ এস্টেট মুন্সিবাড়ীর স্মৃতি সংরক্ষণ ও সংস্কারের অভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৪০০ বছরের অতীত ঐতিহ্য ও মহাকালের স্বাক্ষী। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার ধরণীবাড়ি ইউনিয়নে কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে এই রাজবাড়িটি,যা সকলের কাছে ‘মুন্সিবাড়ী’নামে খ্যাত।

জানা যায়,কাশিম বাজার এস্টেটের ৭ম জমিদার কৃষ্ণনাথ নন্দী ১টি মামলায় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর বিষয়কে নিজের জন্য অবমাননাকর ও আত্মমর্যাহীন মনে করে তিনি নিজ বাসায় আত্মহত্যা করেন। তিনি মারা যাবার পর তার স্ত্রী মহারানী স্বনর্ময়ী দেবী পরবর্তীতে, কাশিমবাজার এস্টেটের জমিদার হন। তার অধীনে সেইসময় কাজ করতেন বিনোদী লাল নামের একজন ব্যাক্তি, যিনি মুনসেফ(মুন্সী)র কাজ করতেন, অর্থাৎ হিসাবরক্ষকের কাজ। বিনোদী লাল বার্ষিক একশত টাকায় ধরনীবাড়ী এস্টেটের জোতদারী ভোগ করতেন।

কথিত আছে,বিনোদী লাল মুন্সি একদিন পশু শিকার করতে হাতির পিঠে চড়ে বের হন । এক স্থানে তিনি দেখতে পান ব্যাঙ ১টি সাপ ধরে খাচ্ছে। ঐ সময় প্রচলিত ছিলো যে ব্যাঙ যে স্থানে সাপকে ধরে খায়,সেই স্থানে বাড়ী করলে অনেক ধন-সম্পত্তির মালিক হওয়া যায়। বিনোদী লাল তাই ভেবে সেখানে বাড়ি করার মনস্থির করেন। ফিরে গিয়ে তিনি মহারানী স্বনর্ময়ীর কাছে অনুমতি নিয়ে বাড়ি নির্মান করেন ধরণীবাড়িতে। এরপর বিনোদী লালের মৃত্যূ হলে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন তার পালিত পুত্র ব্রজেন্দ্রলাল মুন্সী। ব্রজেন্দ্র লাল মুন্সীর দুই কন্যা ছিলো টিটু ও বুদি নামের। ছোট কন্যা বুদি অল্প বয়সে মারা যায়। বড় কন্যা টিটুকে কলকাতায় বিয়ে দেন তিনি।

বড় মেয়ের বিয়ের সময় আঠারো শতকের সময়ে একটি রাজকীয় বাড়ি নির্মান করেন। ১৯৬০ সালে ব্রজেন্দ্রনাথ মুন্সীর মৃত্যু হয়। তার কোন পুত্র সন্তান ছিলো না। তবে তার স্ত্রী আশালতা মুন্সী পরবর্তীতো বিহালী লাল নামের একজনকে দত্তক নেন ,পুত্র স্নেহে লালন-পালন করেন। আশালতা মুন্সীর মৃত্যুর পর পালক পুত্র বিহারী লাল ভবঘুরে হয়ে যান ,তিনি নির্লোভ তথা মাতাল ব্যাক্তিতে পরিণত হন। সেই সময় চাবাইনবাবগঞ্জের এনজিও কর্মী ছাইফুল অফিসের চাকরীসুত্রে এই বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি পরবর্তীতে বিহারী লাল এর কাছ থেকে বাড়ীটি নিজের নামে লিখে নেন। ছাইফুল হক মারা যাবার পর তার বন্ধু আরিফ দেখাশুনা করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনিও মারা গেলে রাজবাড়িটি এখন পরিত্যক্ত ভবনে পরিণত হয়েছে।

ইতিমধ্যে সংস্কার ও রক্ষনাবেক্ষনের অভাবে বাড়িটির বহু মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হয়ে গেছে,বাড়িটির অনেক জায়গা বেদখল হয়ে গেছে।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়,৩০ একর জায়গার উপর ১৮ একর জুড়ে নির্মিত হয় ঐতিহ্যের এই মুন্সীবাড়ী ।মুন্সিবাড়ীর মুল ফটকের পাশে রয়েছে পুরনো কাঠালি চাপা ফুলের গাছ,তার পাশে বাড়ীটির মুলভবন ,ভবনটির পিছনে রয়েছে শিব মন্দির,মন্দিরের পাশে উন্মুক্ত দোল মঞ্চ,তুলসি বেদী,নাট মন্দির,দূর্গা মন্দির ,মন্দিরের উত্তর-পশ্চিমে স্নানাগার।স্নানাগারের ভিতরে একটি কূপ। আর বিশাল বাড়ীটির সামনে সানবাধানো পুকুর। ভবনটির ভিতরে রয়েছে ৩টি শয়ন কক্ষ,১টি ডাইনিং কক্ষ,১টি রান্নাঘর,১টি অংকন কক্ষ,একদিকে বাথরুম,উপরের তলায় ছাদে বিশ্রাম ঘর ইত্যাদি। যা আজ সংস্কারের অভাবে বিলুপ্ত হওয়ার পথে।

শুধুমাত্র ২টি কক্ষ ও পাশের শিব মন্দিরটি ভালো রয়েছে। বর্তমানে কক্ষ ২টি ধরনীবাড়ি ইউনিয়ন ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে,আর মন্দিরটিতে শিব লিঙ্গ চুরি হওয়ার কারনে রাধা-কৃষ্ণের মূর্তিতে পুজো অর্চনা নিয়মিত হচ্ছে। তবে প্রতিবছর মন্দিরটির সামনে আজো দূর্গোৎসবকে ঘিরে মেলা বসে। ইতিহাস ঐতিহ্যের মুন্সিবাড়ীর অধিকাংশ নির্দশন গুলো সংস্কারের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ছাদের পানি নিস্কাশনের জন্য ১৮টি সিংহ মুখের মধ্যে বর্তমানে ৭টি সিংহ মুখ চোখে পড়ে,বারান্দার রেলিং গুলো চুরি হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে উলিপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল কাদের জানান,’ইতিমধ্যে সংস্কৃত মন্ত্রনালয়কে এ বিষয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে,মন্ত্রনালয় থেকে অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত ,আমরা কোন কাজ করতে পারছি না “।
কর্তৃপক্ষ চাইলেই হারানো এই পুরনো স্মৃতিকে সংরক্ষন করে এটিকে জাদুঘরে রুপান্তরিত করতে পারে এমন অভিমত স্থানীয় বাসিন্দাদের।



Comments are closed.

      আরও নিউজ