শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি
শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

মুজিবনগর দিবস: স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় দিন

উত্তরবঙ্গ ডেস্ক: ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের মহাকাব্যিক স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের এক অমলিন ও অবিস্মরণীয় দিন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনন্য এ দিনে ১৯৭১ সালে তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার এক আমবাগানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন ইতিহাসের সূচনাপর্ব লিখিত হয়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ (২৫ মার্চ দিবাগত রাতে) গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এর তিন সপ্তাহের মধ্যে বৈদ্যনাথতলা নামে পরিচিত ওই বিশাল আমবাগানের এলাকাকেই পরে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয়। এ সময় ঘোষিত হয় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। পরে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখলমুক্ত করতে এই মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বেই পরিচালিত হয় সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ। অস্থায়ী সরকারের দৃঢ় নেতৃত্বে মাত্র নয় মাসের মধ্যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বাংলাদেশের সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতা।

তখন যে স্বাধীন বাংলা অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার গঠিত হয় তাতে রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এএইচএম কামারুজ্জামান দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ ছাড়াও পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় খোন্দকার মোশতাক আহমেদকে। তবে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। এ দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও অনুমোদন দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের চিফ হুইপ ও দিনাজপুরের সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো. ইউসুফ আলী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান।

সেদিনের ঐতিহাসিক মুহূর্তে দেশ-বিদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও শপথ অনুষ্ঠান সফলভাবে শেষ হয়েছিল মেহেরপুর ও মুজিবনগরের একঝাঁক নিষ্ঠাবান ও ত্যাগী কর্মীর সহযোগিতায়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বিপ্লবী সরকারের মন্ত্রিপরিষদের আনুষ্ঠানিক শপথ, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। যাত্রা শুরু হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের।

ইতিহাস রোমন্থনের মাধ্যমে জানা যায়, সেদিন সকাল নয়টার দিকে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে বৈদ্যনাথতলায় যান। গ্রামবাসীর পাশাপাশি দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিক উপস্থিত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক মার্ক টালি ও পিটার হেসের নাম উল্লেকযোগ্য। পরে সেখানে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও আসেন। বেলা ১১টার দিকে বহুল প্রতীক্ষিত শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। মেজর আবু উসমান চৌধুরীর পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুব উদ্দীন আহমেদ ইপিআর আনসারের একটি ক্ষুদে দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় গৌরীনগরের বাকের আলীর কুরআন তেলাওয়াত করেন। পরে ভবেরপাড়া গ্রামের পিন্টু বিশ্বাসের বাইবেল পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম।

মুজিবনগর সরকার গঠনের প্রাক্কালে পঠিত ঘোষণাপত্রের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়: বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলার জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

এ ছাড়াও ঘোষণাপত্রের নবম অনুচ্ছেদে বলা হয়: যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের ওপর তাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে জনসমর্থন দিয়েছে, সেই জনসমর্থন অনুযায়ী আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সমাাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য, সেহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছি এবং তা দ্বারা আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা অনুমোদন করছি।

ঘোষণাপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়: এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী বলে বিবেচিত হবেন।

বাংলা, বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবনগর আদতে সমার্থক শব্দের মতো! ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল ইংরেজ উপনিবেশবাদীদের হাতে তা পুনর্জাগরণের পথ ধরে আবারও উদিত হয়১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার এই আমবাগানে। একাত্তরের এই দিনে বাঙালি জাতির পুনর্জাগরণ মুছে দেয় পরাজয়ের গ্লানি। বাঙালির দীর্ঘ রক্তঝরা সংগ্রাম এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার পর বৈদ্যনাথতলায় রচিত হয় নব্য মহাকাব্য! একাত্তরের অগ্নিঝরা এই দিনেই জন্ম হয় বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শিকড়ের!

সম্পর্কিত

মাত্রই প্রকাশিত