বেরোবি প্রতিনিধি: বিধিবহির্ভূতভাবে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নীতিমালা লঙ্ঘন করে নজিরবিহীন গোপনীয়তায় কিছু কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (৪র্থ গ্রেড) ও সমপর্যায়ের পদে পদোন্নতি দিতে নিয়োগ বোর্ড বসিয়েছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হাসিবুর রশীদ।
শুক্রবার (৩১ মে) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের উপাচার্যের দপ্তরে বিকাল তিনটার দিকে এ নিয়োগ বোর্ড বসে। বিষয়টি জানতে পেরে বৃহস্পতিবার (৩০ মে) বোর্ড বন্ধ করে লিখিতভাবে জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দিয়েছে ইউজিসি। এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও শুক্রবার উক্ত বাছাই বোর্ড অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে।
এর আগেও কয়েকবার নিয়োগ বোর্ড বসানোর চেষ্টা করলেও ইউজিসির নিষেধাজ্ঞায় সফল হননি তিনি। কিন্তু এবার অনিয়ম করে এই পদোন্নতি দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন উপাচার্য। একটু ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে কঠোর গাপনীয়তা রক্ষা করে প্রার্থীদের মুঠোফোনে কল করে বোর্ডে উপস্থিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিষয়টি ইউজিসির নজরে এলে বৃহস্পতিবার এই নিষেধাজ্ঞা দেয় সংস্থাটি। নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত হতে ডাক পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন একাধিক প্রার্থী।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ও সমমর্যাদার চতুর্থ গ্রেড এর পদসমূহে কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী উম্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দিতে হবে। এ বিষয়ে ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি নির্দেশনা প্রদান করে ইউজিসি। যাতে বলা হয়েছে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, অর্থ ও হিসাব এবং লাইব্রেরি এই চার দপ্তরে ৪র্থ গ্রেডভুক্ত অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার বা সমমানের পদ থাকবে। এই পদসমূহে ইউজিসি’র অনুমোদন সাপেক্ষে উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগ দিতে হবে, পদোন্নতি/আপগ্রেডেশন/পর্যায়োন্নয়ন দেয়া যাবে না।
ইউজিসির এই নির্দেশনা অমান্য করে বেরোবির উপাচার্য অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার বা সমমানের পদে পদোন্নতির জন্য গত ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে প্রথমবার কর্মকর্তাদের ৪র্থ গ্রেডে পদোন্নতি দিতে নিয়োগ বোর্ড বসিয়েছিলেন। বিষয়টি ইউজিসির নজরে এলে ১১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে পদোন্নতি বা আপগ্রেডেশন কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ প্রদান করে এবং দুই কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা তলব করেছিল।
এরপর ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তারিখে পুনরায় একই পদে আপগ্রেডেশনের জন্য নিয়োগ বোর্ডের সভা আহ্বান করা হলে কমিশন আবারও ১০ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে পুনরায় এ সংক্রান্ত সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দুই কার্যদিবসের মধ্যে কমিশনকে লিখিতভাবে জানাতে বলে। ফলে দ্বিতীয় দফায় বোর্ডের কার্যক্রম ভেস্তে যায়।
ইউজিসির নিষেধাজ্ঞার কারণে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদ বাছাই বোর্ডের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের আপগ্রেডেশন দিতে না পেরে সরকারি ‘‘চাকরি [স্ব-শাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ] (বেতন ভাতাদি) আদেশ ২০১৫ এর অনুচ্ছেদ ১২’’ এর ভুল ব্যাখাপূর্বক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাগণকে ৪র্থ গ্রেড প্রদানের কার্যক্রম গ্রহণ করলে কমিশন দুই দফা চিঠি দিয়ে সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দিলে এই প্রক্রিয়াটিও বাতিল হয়ে যায়।
ইউজিসির এত আপত্তির পরেও তাদের নির্দেশনা অমান্য করে নতুনভাবে নানা কৌশলে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে আজ ৩১ মে ২০২৪ শুক্রবার বিকেল ৩টায় ৪র্থ গ্রেডে পদোন্নতি দেয়ার জন্য বাছাইবোর্ডের আয়োজন করা হয়েছে। একইসঙ্গে এই নিয়োগ দ্রুত অনুমোদনের জন্য আগামীকাল ১ জুন শনিবার দুপুর ১২টায় সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করা হয়েছে। এর আগের উদ্যোগগুলো ভেস্তে যাওয়ায় এবার যাতে নিয়োগ কার্যক্রমের খবর ইউজিসি জানতে না পারে সেজন্য নজিরবিহীন গোপনীয়তা রক্ষা করছেন উপাচার্য। নিয়োগ বোর্ডের জন্য প্রার্থীদের কোনো কার্ড ইস্যুু করা হয়নি, দেওয়া হয়নি এসএমএসও। সংস্থাপন শাখার দাপ্তরিক মোবাইল নম্বর থেকে উপ-রেজিস্ট্রার শামীমা সুলতানা বুধবার বিকেল ৫টার পর থেকে ২৫ জন প্রার্থীকে মোবাইলে কল করে আজ শুক্রবার বিকেল ৩টায় প্রশাসনিক ভবনে উপস্থিত হতে বলেন। এরপরেও এটি ইউজিসির নজরে আসলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় তারা।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, একজন শিক্ষক নেতার স্ত্রী জুনিয়র এক কর্মকর্তা এবং জনসংযোগ দপ্তরে কর্মরত এক কর্মকর্তাসহ উপাচার্যের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাকে ৪র্থ গ্রেডে প্রমোশন দিতেই মূলত মরিয়া হয়ে উঠেছেন উপাচার্য। এভাবে আপগ্রেডেশন দেওয়া হলে অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা বঞ্চিত হবেন এবং তারা চাকরির সিনিয়রিটি হারাবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্থাপন শাখা বাছাইবোর্ড আয়োজনের বিষয়টি নিশ্চিত করে জানিয়েছে উক্ত বাছাইবোর্ডে উপাচার্যের সভাপতিত্বে ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মোঃ মজিব উদ্দিন আহমেদ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার উপস্থিত থাকবেন।
নিয়োগ বোর্ডের সদস্য এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বোর্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ইউজিসির নির্দেশনা বিষয়টি আমি জানিনা, এ বিষয়ে বোর্ড চেয়ারম্যান (উপাচার্য) ভালো বলতে পারবেন।
ইউজিসির নিষেধাজ্ঞা উপক্ষো করে বারবার এভাবে বাছাইবোর্ড আয়োজনের বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাসিবুর রশীদকে একাধিক বার ফোন করা হলেও তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে শুক্রবার সকালে যোগাযোগ করা হলে ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, আমরা বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে জেনে বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দিয়েছি, আমরা তো আর পুলিশ না যে এখন গিয়ে ওনার মাথায় আঘাত করব, সে সুযোগ আমাদের নাই। আমরা চিঠি দিয়েছি, এখন করলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ যা নিয়ম অনুযায়ী সেটা আমরা নিব। অবৈধভাবে গ্রেড-৪ এ আপগ্রেডেশন দেয়ার কোন সুযোগ নেই সেটাই আমরা জানিয়ে দিয়েছি। এর বাইরে আমার আর কিছু বলার নেই।