শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি
শনিবার, ২৭শে জুলাই, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৬ হিজরি

দেড়শ মিনিটে মুজিব-ইয়াহিয়া

উত্তাল মার্চের ১৬তম দিন আজ৷ পাকিস্তানী হানাদারগোষ্ঠীদের বিরুদ্ধে পুরো মার্চ মাসজুড়েই ছিলো বাঙালীদের অসহযোগ আন্দোলন৷ আন্দোলন আরো জোড়দার হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকে৷ সর্বস্তরের বাঙালী নিজেদের অধিকার ও ন্যায্য আদায়ে সংগ্রামী হয়ে ওঠে৷ দেশের চলমান রাজনীতি ও ভাবমূর্তি শোচনীয় করতে ১৯৭১ সালের আজকের দিনে মুজিব-ইয়াহিয়া দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেন৷ এদিন সকাল পৌনে ১১টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নাম্বার বাড়ি থেকে শোক ও প্রতিবাদের প্রতীক কালো পতাকাবাহী বঙ্গবন্ধুর গাড়ি বের হলো। গাড়ির জানালায় ছিলো বাংলাদেশের সম্ভাব্য লাল-সবুজের পতাকা৷ লাখো বাঙালি হত্যার প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান । এভাবে পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করতে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে গত কয়েক দিনে এ দেশে পাক সেনারা যা ঘটিয়েছে তার প্রতিবাদ এবং আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য সমাধান না এলে চূড়ান্তভাবে গাঢ় সবুজের পটভূমিতে লাল সূর্যের বুকে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা পতাকা উড়বে।
এদিন সকাল থেকেই উৎসুক জনতা অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া খানের বৈঠকের ফল কী হয় তা জানতে। এক হাতে কালো পাইপ, অন্য হাতটি তিনি নাড়ছেন জনতার উদ্দেশে। সকাল ১০টায় প্রেসিডেন্ট হাউজে শুরু হওয়া বৈঠকটি শেষ হয় দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের জানান, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আরও আলোচনা হবে। তবে ইয়াহিয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি।
পাক প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বৈঠক সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রধান শিরোনামে লেখা হয়- ‘সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী বাঙালির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় নীতি ও শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে দেড়শ মিনিট কাল স্থায়ী এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন…।’ একজন চাইছেন আলোচনার মাধ্যমে সমাধান, অন্যজনের মনে গনহত্যার নীল ছক আঁকা ছিল। একজনের মনে স্বাধীনতার মন্ত্র, অন্যজনের মনে সব নির্মূল করার বাসনা। এই আলোচনার প্রেক্ষাপটে সেখানে বৈঠক কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে! ইতিহাসের দিকে তাকালেই এ সত্যতা পাওয়া যায়।
১৬ মার্চ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আলোচনার পাশাপাশি সারাদেশে আন্দোলন বাঁধভাঙ্গা রূপ নেয়। রাজপথ মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত করে রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষজনও দেশের উদ্ভূত সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ মন্তব্যের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। এরই মধ্যে ৩ মার্চ থেকে শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে। মাঠে-ময়দানে সর্বত্রই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা নিয়ে তোলপাড়।
দেশের সর্বত্র সেদিন উড়ছিল কালো পতাকা। গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। সব বয়স সব পেশা ও শ্রেণীর মানুষ বেরিয়ে আসতে থাকে রাজপথে। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বঙ্গবন্ধুকে আরও উজ্জীবিত করতে রাস্তায়, মাঠে- ময়দানে তখন গণসঙ্গীত, নাটক, পথনাটক ও পথসভা করে চলছে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বেতার-টেলিভিশন শিল্পী সংসদ, মহিলা পরিষদ প্রভৃতি সংগঠন। হাইকোর্টের আইনজীবী, বেসামরিক কর্মকর্তা কর্মচারীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করতে থাকে। সেদিনের এই বৈঠকের রেষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরো বেগবান করে তুলেছিলো৷

সুরঞ্জন মজুমদার                                              লেখক ও রাজনীতিবিদ

সম্পর্কিত