মার্চ ২৪, ২০২৩ ১২:০২ সকাল



ডিসটিনির সম্পদ হরিলুট হচ্ছে : দেখার কেউ নেই!

 

ইখতিয়ার উদ্দীন আজাদ:
ডেসটিনি প্রায় আট বছর আগে বন্ধ হওয়া এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ বেহাত হতে চলেছে। শুধু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে লুটপাট হয়ে যাচ্ছে এসব সম্পদ। এর মধ্যে বিতর্কিত বহুস্তর (এমএলএম) কোম্পানি ডেসটিনির ঢাকাসহ সাতটি বিভাগীয় শহরে অব্যবহৃত থাকা জমি ও ফ্ল্যাটগুলোর কোনটিতে থাকছে পুলিশ; কোনটি প্রভাবশালীদের দখলে; বাকিগুলোও বেদখলের পথে। এছাড়া চারতারকা হোটেল, কোল্ড স্টোরেজ, পাটকল ও ফুড ইন্ডাস্ট্রি অবহেলায় পড়ে আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিনিয়োগকারী গ্রাহকদের টাকায় লাগানো গাছপালা উজাড় করে ফেলছে যে যার ইচ্ছামতো। এসব সম্পদের বাইরে জব্দ থাকা ডেসটিনি গ্রুপের ৫৩৩ ব্যাংক হিসাবে পড়ে আছে প্রায় দেড়শ কোটি টাকা। ডেসটিনির সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদের হদিস পায়নি সরকার। কমিশন করে গ্রাহকদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে তা সফল করতে পারেনি সরকার। ডেসটিনি গ্রুপের নামে থাকা সম্পত্তি, বিভিন্ন কারখানা বন্ধ রয়েছে প্রায় আট বছর। ডেসটিনি কোম্পানির কারখানাগুলোর বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি মরিচায় নষ্ট হচ্ছে। রাতের আঁধারে কে বা কারা দামী মেশিনপত্র খুলে নিয়ে গেছে।

ডেসটিনি গ্রুপের আয়-ব্যয় এবং দায়সহ সম্পত্তির পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরে গ্রুপটির অর্থ ও ব্যবস্থাপনা পরামর্শক রণজিত চক্রবর্তী গত ২৩ সেপ্টেম্বর ‘ডেসটিনি গ্রুপ সম্পর্কিত প্রকৃত তথ্যাবলি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেসটিনি গ্রুপের মোট ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত মূলধন ৪,৪০৮ কোটি টাকা, পরিশোধিত মূলধন ১,৬৩৫ কোটি টাকা। ২০০০ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরুর পর ২০১২ সালের মে পর্যন্ত ডেসটিনি ২০০০, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি (ডিএমসিএসএল) ও ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশনের (ডিটিপিএল) মোট আয় ৫,১২১ কোটি টাকা। এই অর্থ থেকে কমিশন ব্যয় ১,৪৫৬ কোটি, ট্যাক্স ও ভ্যাট পরিশোধ খাতে ৪১০ কোটি টাকা, পণ্য ক্রয়ে ৪২৫ কোটি টাকা, লভ্যাংশ ও সুদ পরিশোধে ২৬৪ কোটি, ২০০ অফিসের প্রশাসনিক ব্যয় ৪৩৭ কোটি, বৃক্ষরোপণে বিনিয়োগ ২২৩ কোটি, সম্পদ ক্রয় ও বিনিয়োগ খাতে ১৮৯০ কোটিসহ মোট ব্যয় হয়েছে ৫১০৫ কোটি টাকা। ডেসটিনি গ্রুপের এই কোম্পানির মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৯৬৮ একর, ঢাকা শহরে এ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে ৭৪,০৫৮ বর্গফুট। এ ছাড়া বাণিজ্যিক এ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে ২৪,৫৪৭ বর্গফুট। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডেসটিনি গ্রুপের মোট সম্পদের বর্তমান মূল্য ৯,৬৬৫ কোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেসটিনির ৫৮টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ১৬টি বেদখল। এছাড়া পল্টন, পুরানা পল্টন, শান্তিনগর, কাকরাইল, গুলশান, বনানী, ভাটারা ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ডেসটিনির ৯টি এবং ১৪টি স্থাপনার তিনটি এখনও পুলিশ দখলে নিতে পারেনি। পুলিশের জব্দ করা গাড়ি, বাড়ি ও জমির মালিকানা দাবি করে আদালতে গিয়ে আটটি গাড়ি জিম্মায় নিয়েছেন কয়েকজন ব্যক্তি। জমির মালিকানা নির্ধারণের কয়েকটি আবেদনও বিচারাধীন আছে। ঢাকার কাকরাইলে রাজমণি ঈশা খাঁ হোটেলের পশ্চিম পাশে ডেসটিনির জমি পুলিশ দেখভালের দায়িত্ব নেয়ার পরও বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতা ওই জমির মালিকানা দাবি করেছেন। আদালতের আদেশে ওই জমি ক্রোক করার ছোট্ট একটি সাইনবোর্ড যেন আড়াল হয়ে গেছে আর বিএনপি নেতার লাগানো বিশাল সাইনবোর্ডে বলা হয়েছে, ‘এই সম্পত্তির মালিক রোজা প্রপার্টিজ লিমিটেড’।

জানা গেছে, ডেসটিনির নামে ঢাকায় যেসব সম্পদ রয়েছে তার রিসিভার হিসেবে কাজ করছে ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। এর বাইরে জেলা পর্যায়েরও সম্পদগুলো আংশিকভাবে দেখাশোনা করছেন জেলা পুলিশ সুপার। ঢাকাসহ অন্যান্য জায়গার তিনটি সিনেমা হল, অর্ধশতাধিক ফ্ল্যাট ও অর্ধশত গাড়ির মালিকানা এখন পুলিশের। তবে ডিএমপি বলছে, তারা শুধু রিসিভার। ফ্ল্যাটের ভাড়া ও সিনেমা হলের আয় সবই জমা হচ্ছে ব্যাংক হিসাবে। তবে গাড়িগুলো ব্যবহার করছেন পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা।

ঢাকার বাইরে অন্তত দেশের ২২টি জেলায় ডেসটিনির বিভিন্ন ধরনের সম্পদ রয়েছে। এর পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এসব সম্পদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পরিচালকের নামে রয়েছে। তবে গ্রুপভুক্ত ৩৭ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ডেসটিনি ২০০০, ডেসটিনি মাল্টিপারপাস ও ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশনের নামেই বেশির ভাগ সম্পদ। রাজধানীর বাইরে মুন্সীগঞ্জে রয়েছে সবচেয়ে বেশি সম্পদ। এ জেলার সিরাজদীখানেই রয়েছে ১ হাজার ৩০০ কাঠা জমি। এছাড়া বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে রয়েছে ২৪টি রাবারবাগান। খুলনায় ৭ একর জমি, ছয় বিভাগীয় শহরে ডেসটিনি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস সেন্টার নির্মাণের জমি, কক্সবাজারে জমিসহ নির্মীয়মাণ হোটেল ও গাজীপুরে ডেসটিনি এ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ স্থাপনের জন্য জমি রয়েছে। এসব সম্পদের সবই এখন সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, পুলিশ ও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের ভোগদখলে রয়েছে বলে জানা গেছে। কোথাও কোথাও ফ্ল্যাট ও জমির মালিকানাও পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডেসটিনির নামে থাকা রাজধানীর বাইরের সম্পদ পুরোপুরি রক্ষণাবেক্ষণ করছে না পুলিশ। কয়েকটি জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের কোন নির্দেশনা নেই তাদের কাছে। ফলে সম্পদগুলো অরক্ষিত থেকে যাচ্ছে। বেশির ভাগ সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। এর মধ্যে রাজশাহীর বর্ণালি সিনেমা হলটি বন্ধ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সিনেমা হলের মাঠে মাঝেমধ্যে মেলা বসে। বর্তমানে সম্পত্তির দখল নিয়েছে রাজশাহী সিটি মেয়র, সেখানে তৈরি করেছে সিটি করপোরেশনের অস্থায়ী গ্যারেজ।
বান্দরবানের লামা উপজেলায় রয়েছে ডেসটিনির সবচেয়ে বেশি রাবারবাগান। এগুলো পুরোপুরি অরক্ষিত। যাদের কাছ থেকে এ বাগানগুলো কেনা হয়েছিল, তারাই এখন এগুলো দখলে নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া কক্সবাজারে সাগরপারের সি উন পয়েন্টে ৯ তলাবিশিষ্ট চারতারা হোটেল ‘ডেসটিনি ক্রাউন প্যাসিফিক হোটেল এ্যান্ড রিসোর্ট’-এর ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে পাঁচ বছর আগে থেকে। এরই মধ্যে কয়েক দফায় একটি গোষ্ঠী হোটেল ভবনটি দখলের চেষ্টা করেছে।



Comments are closed.

      আরও নিউজ