আপনি কোন দেশে এবং কোন বিষয়ে পড়ছেন?
আমি এখন থাইল্যান্ডে অবস্থান করছি। এখানকার একটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইমিউনলজি বিভাগে Infectious Disease এর উপর PhD করছি। এর আগে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে অনার্স করেছি।
নিজের সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
প্রফেশনালি আমি একজন গবেষক হলেও এডভেঞ্চার ফিল্মমেকিং আমার নেশা। সম্প্রতি ইউটিউবে আমার নেপালের এভারেস্ট বেইজক্যাম্পের উপর প্রকাশিত হওয়া ৫ পর্বের একটি সিরিজ দর্শকমহলে ব্যপক সমাদৃত হয়েছে। বাংলাতে অনেক অনেক ট্রাভেল ভ্লগ থাকলেও এডভেঞ্চার নিয়ে খুব কম কাজ হয়। আমি নিজেও যেহেতু ট্রেকিং,হাইকিং,ক্যাম্পিং টাইপের এক্টিভিটিস পছন্দ করি তাই ভাবলাম কেন এই মূহুর্তগুলিকে আমি ক্যামেরাবন্দি করব না? time is precious…. জীবনের এই গোল্ডেন age টাকে আর কখনোও ফিরে পাবনা। তাই সামর্থ অনুযায়ী সেটার পূর্ন স্বাদ নিতে চাই। বৃদ্ধ বয়সে দুজন ভিডিওগুলি দেখব আর ভাববো, “বাহ আমরা কত্ত কুল ছিলাম!” পরবর্তিতে আমাদের প্লান সেভেন সামিটের পথে যাত্রা শুরু করা।
ছোটতে কি হওয়ার ইচ্ছে ছিল ?
ছোটবেলায় কেউ ক্লাসে এই প্রশ্ন করলে আমার উত্তর শোনার পর একটা হাসির রোল পড়ে যেত! সবাই যেখানে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবার সপ্ন দেখত, আমি সেখানে মহাকাশ বিজ্ঞানী হবার কথা বলতাম। মহাকাশে প্রানের অস্তিত্তর ব্যপারটা আমাকে বরাবরই খুব টানত। অনার্সের ৩য় বর্ষ থেকেই নিজেকে গবেষনায় ডুবিয়ে দিয়েছিলাম। বর্তমানেও সেই পথেই হাটছি এবং আমি সপ্ন দেখি যে একদিন মহাকাশে প্রানের অস্তিত নিয়ে গবেষনা করব। যদি সে সপ্ন পূরন নাও হয় তবুও মানবজাতির কল্যানে আমার গবেষণার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।
বিদেশি পড়তে যাওয়ার ইচ্ছে কে?
— এই প্রশ্নটা যতটা সহয গুছিয়ে উত্তর দেয়া ঠিক ততটাই কঠিন কারন উত্তরটা আমাদের কারোরই অজানা নয়।
আমাদের দেশ গবেষনামুখি একটা প্রজন্ম তৈরীতে অনেকটাই ব্যর্থ। গবেষনায় ভালো সুযোগ এবং
ক্যারিয়ারের সিকিউরিটি না থাকায় পাশ করেই ছাত্রদের কিছু অংশ লেগে পড়ে সরকারী চাকুরির খোজে আর কিছু অংশ পাড়ি জমায় বিদেশে। দেশের বাইরে গবেষনার ভালো সুযোগ, প্রয়োজনীয় বাজেট, মোটা অংকের স্কলারশিপ, ক্যারিয়ার সিকিউরিটি সব কিছুই আছে যেটা দেশে থেকে সম্ভব নয়। অথচ চাইলেই আমাদের দেশের পক্ষেও কিন্তু এমন পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব!
আবার এখানে পড়াশোনা শেষ করে ছাত্ররা দেশে ফিরে যাবে কিনা এটা নিয়েও কিন্তু কনফিউশান এ ভোগে। থাইল্যান্ডে আমি দেখেছি এখানকার স্টুডেন্টরা যখন দেশের বাইরে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যায়, দেশে ফেরার আগেই বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি অথবা গবেষনা প্রতিষ্ঠান তাদেরকে নিজেদের দলে ভেরানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। দেশেই যেহেতু ভালো সুযোগ হয়ে যায় তাই তারা পড়াশোনা শেষ করা মাত্রই দেশে ফিরে এসে দেশ কে সার্ভ করে। এভাবে তারা দেশের রত্ন দেশে ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা এরকম লোভনীয় সুযোগ তৈরী করতে ব্যর্থ হয়েছি। যে কারনে দেশ থেকে একবার বের হলে কেউ আর দেশে ফিরে আসে না! এটা দেশের উন্নতির জন্য হতাশাজনক!
বিবাহিত হওয়ার পরও এমন চ্যালেজিং সিন্ধান্ত নেওয়ার কারণ ও পারিবারিক সাপোর্ট?
— আসলে বিয়ে কোন চ্যালেঞ্জ না বরং বন্ধুত্তের অপর নাম। বিয়ের মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ারে বাধা নয় বরং নতুন একজন মানুষকে পাওয়া যায় যে আপনাকে সাপোর্ট করবে, আপনার পাশে থাকবে। কিন্তু আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এখানে এটা একটা রুলসে পরিনত হয়ে গেছে যে বিয়ে করলে একটা মেয়ের ক্যারিয়ার শেষ! এমনটা কাম্য নয়। আমাদের উভয়পক্ষেররই দৃষ্টিভংগিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
আমি মনে করি আমি যেভাবে আমার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারছি, পাশাপাশি ইউটিউবে শখের বশে মাউন্টেনিয়ারিং এর উপর যে ভিডিওগুলি আপ্লোড করতে পারছি এমনকরে যে কোন ছেলে-মেয়েই তার সপ্ন নিয়ে কাজ করতে পারে, এটা কোন ব্যপার না!
কিন্তু এটা সবার ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে ওঠেনা কারন এখানে উভয় পক্ষই দায়ী। একটু বুঝিয়ে বলি, যেমন ধরেন, আমার যেমন একটা অদম্য ইচ্ছা আছে, তেমন আমার পরিবার এবং আমার হাজবেন্ড আমাকে একটা সুন্দর পরিবেশ দিয়েছে যেন আমি আমার ইচ্ছের ডানা মেলে ধরতে পারি।
এখন এই গল্পে যদি যেকোন এক পক্ষকে আমরা বাদ দিয়ে দেই তাহলে গল্পটা কেমন হবে? উত্তরটা কিন্তু এখানেই নিহিত। বিয়ের মাধ্যমে আমরা একে অন্যের সহোযোগি হই, প্রতিদ্দন্দি নই। বরং আমি বলতে চাই বিয়ে করে এই মানুষটা কে যদি আমার জীবনে না পেতাম তাহলে হয়ত আমাকে মানসিক সাপোর্ট দেয়ার মত কাউকে পেতাম না!
আমার স্কলারশিপ হবার পর আমার হাজবেন্ড দেশের একটা লোভনীয় চাকুরী ছেড়ে দিয়েছিল। আমাকে এক বারোও বলেননি যে তুমি স্কলারশিপ ছেড়ে দাও। চাকুরী ছাড়ার সময় কিন্তু সে জানত না যে তার ভবিষ্যত কি! সে শুধুমাত্র আমাকে ভালোবেসে এই ত্যাগ সীকার করেছিল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাকেও নিরাশ করেননি। এখন সে দেশের চাইতেও ভালো একটা চাকুরী করছে। আপনি যদি আমার হাজবেন্ডকে জিজ্ঞাসা করেন সে ও আমার সম্পর্কে একই উত্তর দেবে, কারন তার জীবনের কোনো না কোনো স্টেজে আমিও তাকে সাপোর্ট দিয়েছি! আমরা একে অন্যের সহযোগি এবং বিশ্বস্ত বন্ধু! এবং আমরা এটাও বিসসাস করি যে ভালোবাসার প্রতিদান সৃষ্টিকর্তা আরো বড় আকারে ফিরিয়ে দেন, শুধু তার প্রতি আস্থা রাখতে হবে।
মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষা চ্যালেঙ্জ, আপনার ক্ষেত্রে এমন কি ছিল?
— আমি বিসসাস করি যারা একবার স্থির করে যে তারা পড়শোনা কন্টিনিউ করবে তাদের জন্য কোন কিছুই চ্যালেঞ্জিং না। হ্যা এটা ঠিক, অনেক সময় পরিবার সাপোর্টে থাকে না, বুঝতে চায় না। আমি যে সহযোগিতাপূর্ন পরিবেশ পেয়েছি সেটা হয়ত অনেকেই পায়না। দেখুন আমি উপরে শুধু আমার পজিটিভ গল্প গুলিই বলেছি। আমার জার্নির খারাপ সময়গুলি নিয়ে কিন্তু বলিনি। বলতে চাই ও না। কারন এখন আমি এমন একটা সময়ে চলে এসেছি যে খারাপ সময়গুলি আমার আর মনেই নেই! খারাপ সময়ে আমি সর্বদা একটা বিষয়ই মাথায় রাখতাম যে, “এখন যারা আমাকে বুঝতে পারছেনা, সাপোর্ট করছেনা, একটা সময় তারাই আমাকে নিয়ে গর্ব করবে। কিন্তু আমি যদি থেমে যাই তাহলে এই মূহুর্ত টা আমি কখনই দেখতে পাবোনা!” এবং সত্যি সত্যি হয়েছেও তাই! সেই মানুষগুলো এখন আমাকে নিয়ে গর্ব৷ করে! আমি যা কিছু পেয়েছি তা আমি সঠিক উপায়ে অর্জন করে নিয়েছি। তাই আমি বলব সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মনের জোড় কে টিকিয়ে রাখা এবং একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অটল থাকা।
এর বাইরে বলতে গেলে বলতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে মেয়েদের নিজেদের এবং তাদের কাজের নিরাপত্তা নিয়ে। ডিপার্টমেন্টে অথবা ডিপার্ট্মেন্টের বাইরে নিরাপত্তার অভাবে অনেক মেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে গবেষনামুখি হতে চায় না। আমি এখানে রাত ১২টা-১টা পর্যন্ত নির্দিধায় কাজ করি। সেইফলি বাড়ি ফেরা নিয়ে আমাকে ভাবতে হয়না। কারন এখানে আমার সেই নিরাপত্তা আছে, যেটা দেশে কল্পনাই করতে পারতাম না!
সর্বপরি অন্যান্য মেয়েদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতে চান:
— বলা মানে তো শেষ হয়ে যাওয়া, কিন্তু না বলা মানে অনেক কিছু বলা। শুধু মেয়েরা না, আমার বিসশাস ছেলে- মেয়ে উভয়েই আজকে আমার লেখাগুলি পড়ে অনেক হিডেন এবং ডিপ বিষয় অনুধাবন করতে পেরেছে। আমি এটাই তাদের ম্যাসেজ হিসেবে বলতে চেয়েছি যে, প্রত্যেক্টা মানুষের জীবন আলাদা, তাদের প্লান আলাদা, সপ্ন আলাদা। কিন্তু এক্সিকিউশনের প্রসেস সেইম। জীবন কে যদি আমরা টেস্ট ক্রিকেট খেলার সাথে তুলনা করি তাহলে তুমি হলে ব্যাটসম্যান আর বোলারের প্রতিটা বল তোমার সামনে একেকটা প্রব্লেম। তোমাকে প্রতিটা বলে ছক্কা হাকাতে হবেনা। কিন্তু যদি তুমি নিজের উইকেটটা বাচিয়ে খেলতে পারো, তাহলে দিন শেষে তোমার ঝুলিতে একটা ডাবল সেঞ্চুরি আশ্চর্যজনক কোন বিষয় নয়। আর যদি হাল ছেড়ে দাও- জীবনের খেলায় তুমি “আউট”!
ইশরাত জাহান খান চৌধুরী
পি এইচ ডি ফেলো, মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইমিউনলজি
মাহিদোল ইউনিভার্সিটি, থাইল্যান্ড।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন
~মো: আরিফুল ইসলাম
সভাপতি, ২০২৩-২৪ কার্যবর্ষ , বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক, ফোরাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা এবং
শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ, সেশন: ২০১৮-১৯, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল: s1910926146@ru.ac.bd