রুশাইদ আহমেদ: প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী হ্যারল্ড লাস্কি বলেছিলেন, “স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সেই পরিবেশের সাম্য সংরক্ষণ, যেখানে মানুষ তার সত্তাকে পূর্ণ উপলব্ধি করার সুযোগ লাভ করে।” কিন্তু মানুষের নিজ সত্তাকে পূর্ণ উপলব্ধি করার উপায় আসলে কী? আমার মতে, মানুষ তখনই নিজ সত্তাকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ পায় যখন সে নিজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য চর্চা ও স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অবাধ অধিকার লাভ করে যথোপযুক্ত পরিবেশে।
কিন্তু ইতিহাসের পাতায় দৃষ্টি রাখলে দেখা যায়, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি দেশে বিভক্ত হওয়ার পর যখন পূর্ব বাংলা পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়, তখন সেখানকার মানুষেরা নিজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য চর্চা ও স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়নি প্রতিকূল পরিবেশে। কারণ দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভব হয়েছিল মূলত ধর্মীয় বিভেদরেখার ওপর ভিত্তি করে। সেখানে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালির নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে গ্রাহ্য করা হয়নি।
তাই বাঙালি সংস্কৃতি ও পশ্চিম পাকিস্তানি সংস্কৃতির মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ থাকলেও শুধু ধর্মীয় কারণে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে ব্রিটিশ দুঃশাসন থেকে পাকিস্তানি ও ভারতীয় জাতি স্বাধীনতা লাভ করলেও পূর্ব বাংলার আপামর বাঙালি জাতি প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের কপালে নেমে আসে এক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিপীড়ন থেকে আরেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শোষণের খড়গ!
মূলত পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই দেশটির সকল রাষ্ট্রক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানিরা একচেটিয়াভাবে কুক্ষিগত করতে শুরু করে। এবং এ কুক্ষিগত করে রাখার অংশ হিসেবে তারা পূর্ব পাকিস্তানে সেই ধর্মকেই অপব্যবহার করে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আগ্রাসন চালানোর চেষ্টা চালিয়ে বাঙালি জাতিকে দমিয়ে রাখার পথে পা বাড়ায়। পাশাপাশি তারা সামরিক, শিক্ষা, চাকরি, বাজেট বরাদ্দসহ সর্বত্র গড়ে তোলে বৈষম্যের এক মহাপ্রাচীর!
এমনকি তারা বাঙালি জাতির মাতৃভাষাকে নিয়েও অপরাজনীতির সূত্রপাত ঘটায়। কেননা মাতৃভাষাই হলো একটি জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চর্চার প্রধানতম বাহন। আর এ বাহনকে অকেজো করে ফেললে সহজেই তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে গ্রাস করে তাদেরকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
তবে ১৯৫২ সালে তাদের এ ঘৃণ্য অপচেষ্টাকে রুখে দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি প্রথমবারের মতো যে সাফল্য অর্জন করে, তা-ই পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে এ জাতিকে সকল অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক স্বাধিকার আন্দোলন গড়ে তোলার প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এরই পরিক্রমায় ১৯৬৬ সালে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বাঙালির মুক্তির সনদখ্যাত ‘ছয় দফা’ দাবি পেশ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরে ১৯৬৯ সালে বাঙালির প্রগতিশীল জাগরণের ফলে ঘটে পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান। এবং সবশেষে ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি জাতি অর্জন করে তাদের বহুলাকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
কিন্তু প্রায় দুই যুগ ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে শোষিত হওয়ার পর নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে শোষণহীন সমাজ বিনির্মাণের অভিপ্রায়ে, তা কি পরিপূর্ণতা পেয়েছে স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে এসেও?
উত্তর হলো— না! কেন পায়নি? কারণ আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের যে মূল ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চর্চা— তা থেকে আমরা দূরে সরে এসেছি স্বাধীনতা লাভের পরে। এ বিষয়ে এখন কিছুটা খোলাখুলি আলোচনা করা যাক।
১৯৫২ সালে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষে আমাদের জাতির মধ্যে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি যে ভালোবাসা পরিলক্ষিত হয়, তা স্বাধীনতা লাভের পর আর অটুট থাকেনি। স্বাধীনতা অর্জনের পর পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি আমাদের মেকি ঝোঁক এবং পুঁজিবাদী চেতনা আমাদেরকে নিজ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য চর্চায় নিরুৎসাহিত করতে শুরু করে।
অথচ ষাটের দশকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানোর সময় নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য এ বাঙালি জাতিই গড়ে তুলেছিল ছায়ানট, ক্রান্তি, উদীচীর মতো সাংস্কৃতিক সংগঠন। কিন্তু স্বাধীনতা পেয়ে আমরা নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে অগ্রসর হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার গৌরবকে খর্ব করে ফেলি অনেকটাই। এমনকি নিজস্ব ঐতিহ্য লালনেও আমাদের সৃষ্টি হয়েছে তুমুল অনীহা।
আজকাল আমাদের মাঝে দেশীয় ঐতিহ্যবাহী দিবস পালনের চেয়ে বিদেশী সংস্কৃতির দিবস পালনের প্রবণতা দেখা যায় বর্ণাঢ্যভাবে অনেক ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, থার্টি ফার্স্ট নাইট কিংবা ইংরেজি নববর্ষ থেকে শুরু করে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ এখন যতটা ঘটা করে বাঙালিরা পালন করেন; পহেলা বৈশাখ কিংবা স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস ততটা মহাসমারোহে করেন না অনেক বাঙালি।
আবার যেখানে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদই ছিল আমাদের স্বাধীনতা লাভের দৃঢ়তম সোপান— সে জায়গাটি থেকেও আমাদের বিচ্যুতি ঘটেছে। ফলে বর্তমানে আমাদের স্বাধীন ভূখণ্ডে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের (হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে বৃহৎ বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের) দপ্তরের ভবনের প্রবেশমুখে সাইনবোর্ডে দেখা যাচ্ছে বিদেশি ভাষা ইংরেজির ছড়াছড়ি।
পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের তরুণসমাজসহ অনেক জ্যেষ্ঠ নাগরিকেরাও ইংরেজি অক্ষর দিয়ে বাংলা লিখছেন। এতে যেমন ঘটছে বাংলা ভাষার বিকৃতি, তেমনই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে ১৯৫০ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক গঠিত মাওলানা আকরাম খানের কমিটির আরবি হরফ দ্বারা বাংলা অক্ষর প্রতিস্থাপনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের করা আন্দোলনের সোনালী ইতিহাস!
ফলে এ প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত পরে এ স্বাধীন ভূখণ্ডের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে ঔপনিবেশিক মননের পরিবর্তে স্বদেশী মনন গঠনের লক্ষ্যে ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন বক্তৃতায় ইংরেজ ও পাকিস্তানি উপনিবেশের চিন্তাধারা ঝেড়ে ফেলে স্বাধীন দেশের জন্য নতুন মানসিকতা লালনের কথা বলেছিলেন, সেখানে বর্তমানে আমাদের ভূমিকা আসলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে— সেটি জাতির সম্মুখে সত্যিই এক বড় প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে!
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।